বাংলাদেশ ব্যাংক চার কার্যদিবসে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তুলে নিলো সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা
অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশ ব্যাংক বিদায়ী সপ্তাহের চার কার্যদিবসে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তুলে নিলো সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। ৭ দিন থেকে ৩০ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে এ টাকা তুলে নেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাজারে অস্বাভাবিক হারে নগদ টাকা বেড়ে গেছে। ঈদের আগে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে নগদ টাকা বেড়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে বাজারে টাকার সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি সহনীয় অবস্থানে রাখতেই এ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে ওই সূত্র মনে করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশে একটানা ৯ দিন সরকারি ছুটি অতীতে কখনো হয়নি। এর ফলে অন্য বছরের তুলনায় এবার ঈদের আগে গ্রাহক বেশি টাকা উত্তোলন করেছেন। আবার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ঈদবোনাসসহ সরকারের নানা দায়দেনার জন্যও বেশি অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। সব মিলে বাজারে নগদ টাকার প্রবাহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে।
জানা গেছে, দৈনন্দিন লেনদেন মেটানোর জন্য জনগণের হাতে নগদ অর্থ থাকে। একইভাবে ব্যাংকগুলোও তাদের দৈনন্দিন লেনদেন মেটাতে জনগণের কাছ থেকে যে পরিমাণ আমানত গ্রহণ করে, তার একটি অংশ বিনিয়োগ না করে নগদে রাখা হয়। আবার ব্যাংকের হাতে চাহিদার অতিরিক্ত নগদ টাকা থাকলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা ব্যাংকগুলোর চলতি অ্যাকাউন্টে টাকা রাখা হয়। চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ অর্থ উত্তোলন করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এই তিন ধরনের মুদ্রার সমন্বয়কে রিজার্ভ মুদ্রা বলে। বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত এই রিজার্ভ মুদ্রাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। রিজার্ভ মুদ্রা অর্থাৎ মানুষের হাতে বেশি অর্থ এলে বেশি হারে কেনাকাটা করে। টাকা যত বেশি হাতবদল হয় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার তত আশঙ্কা থাকে। আর এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক তার মুদ্রানীতিতে রিজার্ভ মুদ্রা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ধরে রাখার কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রিজার্ভ মুদ্রা ১ লাখ ৬৯ হাজার ২০০ কোটি টাকার মধ্যে রাখার কর্মসূচি ছিল। কিন্তু দেশের স্মরণকালের দীর্ঘমেয়াদি সরকারি ছুটি থাকায় রিজার্ভ মুদ্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। ঈদের আগে এ রিজার্ভ মুদ্রা বেড়ে হয় ১ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রিজার্ভ মুদ্রা বেড়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন মুদ্রানীতি প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রিজার্ভ মুদ্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে না পড়লেও তিন-চার মাসের মাথায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কেননা, রিজার্ভ মুদ্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাপক মুদ্রা বেড়ে যাবে। আর এর সরাসরি প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মানুষের হাতে থাকা টাকা বেশি হারে উৎপাদনশীল খাতে হাতবদল হলে মূল্যস্ফীতিতে অপক্ষাকৃত কম প্রভাব পড়ে। কারণ এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় ও পণ্যের সরবরাহ বেড়ে যায়। এতে আমদানি কমে যায়। ফলে ব্যাপক মুদ্রা বেড়ে গেলে এ ক্ষেত্রে তুলনামূলক মূল্যস্ফীতির ওপর কম প্রভাব পড়ে। কিন্তু মানুষের হাতে থাকা টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে বেশি হাতবদল হলে সরাসরি মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ে। এ ক্ষেত্রে দেশ আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ে।
দেশে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কটের কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। জাতীয় প্রবৃদ্ধিতেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অবদান কমে যাচ্ছে। যেমন ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অবদান ছিল ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) তা ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে এখন রিজার্ভ মুদ্রা বেড়ে যাওয়ার অর্থই হলো মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়া। ইতোমধ্যে মে মাসের তুলনায় জুনে মূল্যস্ফীতি খানিকটা বেড়ে গেছে।
এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রিজার্ভ মুদ্রা অর্থাৎ মানুষের হাতে টাকা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে কয়েক সপ্তাহ ধরেই বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত সপ্তাহের চার কার্যদিবসে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে তুলে নিয়েছে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ জুলাই ৭ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে তুলে নিয়েছে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ১২ জুলাই ৭ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা, ১৪ দিনের জন্য ৩১০ কোটি টাকা ও ৩০ দিনের জন্য ২৪০ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়। ১৩ জুলাই ৭ দিনের জন্য ৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা, ১৪ দিনের জন্য ৬০০ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে অর্থাৎ ১৪ জুলাই ৭ দিনের জন্য ৪ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা, ১৪ দিনের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা এবং ৩০ দিনের জন্য ৩৫৫ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যত দিন পর্যন্ত রিজার্ভ মুদ্রা নির্ধারিত সীমার মধ্যে নেমে না আসবে তত দিন পর্যন্ত বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে যে টাকা তুলে নেয়া হচ্ছে তার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে প্রতি ১০০ টাকার জন্য ২ টাকা ৯২ পয়সা থেকে ২ টাকা ৯৮ পয়সা পরিশোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
Leave a Comment