বাড়ী/বাসা দেখানোর সময় সাবধান, ঢাকায় সিরিয়াল কিলার, এ পর্যন্ত তিনজন নিহত, আহত একজন
অনলাইন ডেস্ক
সুদর্শন যুবক, পোশাক-আশাক ভদ্রস্থ। বয়স ২৫-২৬ বছর। সব সময় হাতে থাকে একটি ব্যাগ। ভাড়া নেওয়ার কথা বলে বাড়ি দেখতে আসে সে। বাড়িতে একা গৃহকর্ত্রী থাকলেই কেবল সে ভেতরে ঢোকে। সুযোগ বুঝে কাঁধের ব্যাগ থেকে চাপাতি বের করে পেছন দিক থেকে মহিলার ঘাড়ে ও গলায় আঘাত করে। এরপর দ্রুত সটকে পড়ে সামান্য কিছু স্বর্ণালংকার নিয়ে, যা গৃহকর্ত্রীর শরীরে থাকে। আর কিছু নেয় না সে।
রাজধানীর দক্ষিণখানে এমনই এক যুবকের উপস্থিতির আলামত পেয়েছে পুলিশ ও এলাকাবাসী। ওই যুবক বাড়িভাড়ার নামে গত দেড় মাসে চারটি বাড়িতে ঢুকে একই কায়দায় হামলা চালায়। যেখানে তিন নারী নিহত হয়েছেন। আহত হলেও বেঁচে গেছেন একজন। তার হামলার শিকার চারজনই বাড়ির মালিকের স্ত্রী এবং মধ্যবয়সী। প্রতিটি ঘটনাই দক্ষিণখান থানা এলাকায় ঘটেছে। সর্বশেষ গত বুধবার বিকেলে গাওয়াইরের দক্ষিণপাড়ায় ওয়াহিদা আক্তার নামে এক নারীকে খুন করে ওই যুবক। পুলিশ তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছে আগের তিনটি ঘটনাও ঘটিয়েছে সে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ বাড়িওয়ালাদের সতর্ক করে গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবারমাইকিং করেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, যুবকটি এক ধরনের ‘সিরিয়াল কিলার’। সিসিটিভির ফুটেজে তার ছবি পাওয়া গেলেও তা অস্পষ্ট। ফলে শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ, র্যাবসহ কয়েকটি সংস্থা এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
প্রসঙ্গত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে আলোচিত এক সিরিয়াল কিলার ধরা পড়ে ২০০৯ সালে, যার নাম রসু খাঁ। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ১১ নিরীহ নারীকে ধারাবাহিকভাবে হত্যা করেছিল সে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিধান কুমার ত্রিপুরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বুধবারের হত্যাকাণ্ডসহ চারটি ঘটনায় একই রকমের আলামত পাওয়া গেছে। ঘটনাস্থলে একজনই ছিল বলে প্রমাণ মিলেছে। ওই যুবকের আর কোনো সহযোগী আছে কি না এবং সে কে—তা বের করতে আমরা তদন্ত চালাচ্ছি।’
দক্ষিণখান থানার ওসি সৈয়দ লুৎফর রহমান বলেন, গত দেড় মাসে তিন মধ্যবয়সী নারী খুনের নেপথ্যে একই ব্যক্তি বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে তার পরিচয় সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
প্রথম ঘটনাটি ঘটে গত ২৪ জুলাই। দক্ষিণখানের উত্তর গাওয়াইরে গৃহকর্ত্রী শাহিদা বেগমকে খুন করে তাঁর সঙ্গে থাকা স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যায় খুনি। তখন পুলিশ ধারণা করেছিল, ডাকাতি বা পূর্বশত্রুতার জেরে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে। এক মাস পর ২১ আগস্ট ঘটে দ্বিতীয় ঘটনা। ওই দিন পূর্ব মোল্লারটেকের তেঁতুলতলার ১১৪ নম্বর বাসার গৃহকর্ত্রী সুরাইয়া বেগমকে একইভাবে হত্যা করা হয়। তৃতীয় ঘটনা ঘটে গত ৩১ আগস্ট।
দক্ষিণ আজমপুরের এ ব্লকের ৩/এ রোডের ৮১/৩৯ নম্বর বাড়িতে জেবুন্নিসা চৌধুরীকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যায় ওই ব্যক্তি। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া জেবুন্নিসা এখন ধানমণ্ডির গ্রিনলাইফ হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। গত বুধবার গাওয়াইরের দক্ষিণপাড়ার ৭১৫ নম্বর বাড়িতে ঘটে সর্বশেষ ঘটনাটি। বিকেলে ছয়তলা বাড়ির দোতলায় গিয়ে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার কথা বলে এক যুবক। পরে গৃহকর্ত্রী ওয়াহিদা আক্তার তাকে নিয়ে ছয়তলার ফ্ল্যাটে যান। কিছুক্ষণ পর তার পরিবারের সদস্যরা গিয়ে দেখেন, ছয়তলায় তাঁর নিথর দেহ পড়ে আছে।
পুলিশ ও স্বজনরা বলছে, ওই যুবক দেখতে সুদর্শন। গায়ের রং ফর্সা। উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির মতো। মাথার চুল ছোট। কখনো সে শার্ট ইন করে পরে। আবার কখনো স্যুট-কোট পরা থাকে। কাঁধে থাকে ব্যাগ। বাড়িতে ঢুকে সে বাসা দেখতে চায়। এরপর সুযোগ বুঝে ব্যাগ থেকে চাপাতি বের করে কুপিয়ে গৃহকর্ত্রীর পরনে থাকা অলংকার নিয়ে চলে যায়। খুনি প্রশিক্ষিত এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। চাপাতি দিয়ে হঠাৎ মাথায় জোরে আঘাত করার কারণে ভুক্তভোগী চিৎকার করতে পারেন না। চারটি বাড়ির নিরাপত্তাব্যবস্থা ভাল ছিল। তার পরও তাৎক্ষণিকভাবে দারোয়ানসহ কেউ তা টের পায়নি।
বুধবার নিহত গৃহকর্ত্রী ওয়াহিদার দেবর ইলিয়াস মজুমদার খোকন বলেন, তাঁর ভাবীর মেয়ে শোভা হোসেন খুনিকে দেখেছেন। তার বয়স ২৫-২৬ বছর। দেখতে খুবই স্মার্ট। তাকে দেখলে ভদ্র এবং চাকরিজীবী বলেই মনে হবে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছে, ওই খুনি ধরা না পড়লে আরো হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে ভয় পাচ্ছে তারা। এলাকায় সতর্কাবস্থায় আছেন বাড়িওয়ালারা। দক্ষিণ আজমপুর এলাকার এক বাড়ির মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘একের পর এক ঘটনা ঘটলেও পুলিশ এখনো খুনিকে ধরতে পারেনি। এমনকি তাকে শনাক্তও করা যায়নি। এতে আমরা ভয়ের মধ্যে আছি।’
দক্ষিণখান থানার ওসি সৈয়দ লুৎফর রহমান গতকাল বলেন, আগত ভাড়াটিয়ার সঙ্গে থাকা ব্যাগ ও অন্যান্য মালামাল তল্লাশি করে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়ার অনুরোধ করে এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। বাড়ির নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি অপরিচিত কাউকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে থানায় খবর দিতে বলা হয়েছে।
Leave a Comment