Breaking News

প্রচ্ছদ > রাজনীতি

মুজিব বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবী সরকার গঠন-নূরে আলম সিদ্দিকী

অনলাইন ডেস্ক
মুজিব বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবী সরকার গঠন-নূরে আলম সিদ্দিকী

সিরাজুল আলম খান। রাজনীতির রহস্যপুরুষ। যিনি সবকিছু ঘটিয়েও নিজেকে অদ্ভুত কায়দায় আড়াল করতে পারতেন। ব্যক্তিজীবনেও অদ্ভুত স্বভাবের মানুষ। টানা তিন-চারদিন রাতি জেগে থাকতে পারতেন। আবার সত্তর থেকে আশি ঘণ্টা ঘুমাতেন।
মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও ছিলেন কট্টর জাতীয়তাবাদী। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনী, পরবর্তীতে জাসদ, গণবাহিনী গঠনসহ নেপথ্যের নানা ঘটনাক্রমের কারিগর ছিলেন সিরাজুল আলম খান। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি তখন মুজিব বাহিনীর নেতৃস্থানীয়রা বিশ্বাস করতেন মুক্তিযুদ্ধ সফল হলেও বঙ্গবন্ধু কোনদিন বাংলাদেশে ফেরত আসবেন না। এই ভাবনার প্রেক্ষিতে সকলেই নীলনকশা আঁকতে থাকেন কোন কৌশলে ক্ষমতা করায়ত্ত করা যায়। মানবজমিনকে দেয়া ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নূরে আলম সিদ্দিকীর বয়ানে পড়ুন সে ঘটনাক্রমের বৃত্তান্ত। 
মুজিব ভাই যখন মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন পাকিস্তানের কারাগারে তখন একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের ধরাবাহিকতায় যারা নেতৃত্বের শীর্ষস্থানে অবস্থান করছিলেন তারা প্রায় সকলেই বিশ্বাস করতেন মুক্তিযুদ্ধ সফল হলেও হতে পারে কিন্তু বঙ্গবন্ধু আর কোনদিন বাংলাদেশে ফেরত আসবেন না। তাকে পাকিস্তানে হত্যা করে সমাহিত করা হবে এবং একটা অজানা-অচেনা জায়গায় এমনভাবে সমাধিস্থ করা হবে যাতে ইতিহাসের গবেষকদের পক্ষেই তার সমাধিস্থল খুঁজে বের করা ভীষণ দুরূহ কাজ হবে। পারলে পাকিস্তানিরা সমাধিস্থলটি বালুর সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। এই ভাবনার প্রেক্ষিতে প্রায় সকলেই মনে মনে নীলনকশা আঁকতে থাকেন। কি কৌশলে ক্ষমতা করায়ত্ত করা যায়। তাজউদ্দিন সাহেব প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তো ছিলেনই তার ওপরে তিনি ইন্দিরা সরকারের মদত ও সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। তাকে ক্ষমতাচ্যুত না করে তাদের মতে ক্ষমতা দখলের কোন সুযোগ ছিল না। মুজিব বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ায় এই ভাবনাটি মারাত্মক প্রাধান্য বিস্তার করে। সুতরাং মুজিব বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সংগঠিত একটি বিপ্লবের মাধ্যমে প্রবাসী সরকারকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক চেতনার আঙ্গিকে একটি বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করা। যদিও এই মুজিব বাহিনী গঠনে ক্রমানুসারে নেতৃত্ব ছিলেন ১. শেখ ফজলুল হক মণি, ২. সিরাজুল আলম খান, ৩. আবদুর রাজ্জাক, ৪. তোফায়েল আহমদ। এর মধ্যে আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ গোপনে গোপনে অন্তর্পণে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে সংযোগ ও সম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। মুজিব বাহিনীর এক নম্বর সংগঠক হিসেবে শেখ ফজলুল হক মণির নাম থাকলেও মুজিব বাহিনীর শক্তির অভ্যন্তরে তার প্রকৃত অর্থে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তিনি একটা ঘোরের মধ্যে অবস্থান করছিলেন। যদি সত্যিকারের অর্থে দেশ স্বাধীনের পর মুজিব ভাই ফেরত না আসতেন আর যদি ভারতীয় একটি রাজনৈতিক লবির সাহায্যে মুজিব বাহিনী কল্পিত বিপ্লব সংগঠন করতে পারতো তাহলে শেখ ফজলুল হক মণি ক্ষমতায় অংশীদার থাকাতো দূরে থাক জীবিতই থাকতে পারতেন না। কারণ শেখ ফজলুল হক মণি মুজিব বাহিনী নিয়ন্ত্রণের মূল ধারায় আদৌ শক্তিশালী ছিলেন না। মুজিব বাহিনী প্রশিক্ষণের পর যে সমস্ত কাউন্সেলিং কেন্দ্রে প্রশিক্ষিতদের কাউন্সেলিং করা হতো তারও পরিকল্পনায় শেখ ফজলুল হক মণির আদৌ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কি আহাম্মকদের সঙ্গেই না মণি ভাই তখন বসবাস করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি তার ভুলটা সম্যক উপলব্দি করতে পেরেছিলেন বলে মানিক মিঞার মতো কলামনিস্ট হওয়ার স্বপ্নবিলাস পরিহার করে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। কিন্তু তখন তার জন্য অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। দেশ স্বাধীনের আগে ভারতে অবস্থানকালে মণি ভাই ভাবতেন মুজিব বাহিনীর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তার রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে তিনি সিরাজ ভাইয়ের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে সম্পূর্ণ বন্দি ছিলেন। তার চিন্তা-ভাবনাও একটা মহাঘোরে আচ্ছন্ন ছিল। দেশ স্বাধীনের পর পরবর্তীতে যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় শেখ ফজলুল হক মণি তার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও আমি প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব নির্বাচিত হই। স্বাভাবিকভাবেই যুবলীগের কাজে-কর্মে, সভা-সমিতিতে মণি ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ক্রমে ক্রমেই বাড়তে বাড়তে চরম ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। আমি অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় মণি ভাইয়ের মগজ থেকে মুজিব বাহিনীর ভূত তাড়াতে সচেষ্ট থাকি। অনেক সময় লাগলেও বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়। মণি ভাই আমার কাছে পরবর্তীকালে অকপটে স্বীকার করেছেন তিনি একটি ঘোরের মধ্যে ছিলেন। তিনি সিরাজ ভাইয়ের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিলেন সম্পূর্ণ নিজের অজান্তে। আমি নিঃসঙ্কোচে এই প্রজন্মকে জানাতে চাই রব, শাহজাহান সিরাজ যেহেতু সিরাজুল আলম খানের ভাবশিষ্য ছিলেন অন্যদিকে আবদুল কুদ্দুস মাখনও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় আগরতলায় অবস্থান করতেন। আগরতলা যেহেতু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্নিকটে তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তরুণ তাজা প্রাণগুলোর একটি বিরাট অংশ আগরতলায় অবস্থান করতেন। তাদের প্রায় সকলেই আমাদের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংয়ের আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে মাখনকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করতেন। সিরাজুল আলম খান অবস্থাটা বুঝতে পারলেও ততখানি উদ্বিগ্ন ছিলেন না। মাখন তার কাছে দুশ্চিন্তার তেমন কারণ ছিলেন না এই জন্য মাখন রাজনৈতিক মানসিকতার চাইতে বড় সংস্কৃতিমনা ছিলেন। সিরাজুল আলম খান আমাকে যতখানি প্রতিপক্ষ মনে করতেন মাখন ও আমি একই চেতনায় বিশ্বাসী হলেও মাখনকে ঠিক ততখানি প্রতিপক্ষ মনে করতেন না বরং তাকে খোশমেজাজেই রাখতেন। মুজিব বাহিনীর দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বে বাহ্যিক হলেও রবের পাশাপাশি অনেকটা সমমর্যাদায় মাখনকে রাখা হয়েছিল। অন্যদিকে শাহজাহান সিরাজ কলকাতায় অবস্থান করলেও চেতনা, বিশ্বাস ও মননশীলতায় সিরাজ ভাইয়ের আস্থাভাজন ছিলেন ফলে মুজিব বাহিনীতে তার অবস্থান কখনোই দুর্বল হয়নি। মধ্য থেকে অত্যন্ত সঙ্গত কারণে মুজিব বাহিনীর গঠন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পরিচালনায় আমাকে বাইরে রাখা হয়। এটা নীতিগত এবং কৌশলগত উভয়দিক থেকেই। মজার কথা সিরাজ ভাই একবার কলকতায় এসে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এ প্রায় চার ঘণ্টা আমার সঙ্গে বৈঠক করেন। তার আলোচনায় যে বিষয়টি প্রাধান্য পায় সেটি হলো তিনি আমাকে বাদ দেবেন এটি তার নৈতিক কর্তব্য কিন্তু শেখ ফজলুল হক মণি মুজিব বাহিনীতে আমাকে রাখার কোন প্রচেষ্টা তো দূরে থাক ভাবনার আবর্তেও আনেননি। এটা সিরাজ ভাইয়ের ভাষ্য মতে, আমাকে শুধু অবহেলা নয় রাজনীতিতে নিঃসঙ্গ করার একটা ষড়যন্ত্রের অংশ। সিরাজ ভাই অবশ্য সিএনসি স্পেশাল গঠন ও এফএফ-এ আমার অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তার বদ্ধমূল, ভ্রান্ত ধারণা ছিল আমি সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে পুরোপুরি বিচ্যুত হয়ে গেছি, স্বাধীন বাংলাদেশে আমার প্রবেশ করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। মুজিব বাহিনীতে অংশ নিয়েছেন এটা আমার প্রতি সহমর্মিতা যাদের ছিল তারা আমার পরিবার, সুহৃদ বিশেষ করে আমার স্ত্রীর কাছে বিষয়টি উত্থাপন করে তাদের আশঙ্কা-সংশয় ও ভীতির কথা জানাতেন। আমি এসব প্রশ্নে আমার পরিবারের সদস্য বিশেষ করে আমার স্ত্রীর কাছ থেকে অবহিত হলে সঙ্কিত তো হতামই না বরং প্রত্যয় দৃঢ় চিত্তে তাদেরকে অভয় দিতাম স্বাধীন বাংলাদেশে ওদের মোকাবিলা করতে আমার কঠিন বেগ পেতে হবে না ইনশাল্লাহ। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস আমার ধারণা ও বিশ্বাসের যথার্থতা প্রমাণ করেছে। তবে অস্বীকার করবো না ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ৪ ঘণ্টা বৈঠকে সিরাজ ভাই আমাকে পরিপূর্ণভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি গংরা আমার প্রতি অবিচার করেছেন; আমাকে মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে বিযুক্ত করার চেষ্টা করেছেন এবং রাজনৈতিকভাবে আমাকে দেউলিয়াত্বের অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চেষ্টা করেছেন। সেদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে বসে এই উপলব্ধি থেকে বিক্ষুব্ধ চিত্তে আমি সিরাজ ভাইয়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিব ভাইয়ের নেতৃত্বে অবিচল-বিশ্বস্ততা রাখবো কিন্তু অন্যরা যারা আমার সঙ্গে অসহযোগিতা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো রাজনৈতিক কার্যকলাপে ও কর্মযজ্ঞে সিরাজ ভাইকে সহযোগিতা দেবো ও সমর্থন করবো। আমার ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হওয়ার কারণ আমাদের রাজনৈতিক যে দু’টি ধারা তার একটি ধারার মুখপাত্র আমি হলেও তার প্রধান পৃষ্ঠপোষকতায় শেখ ফজলুল হক মণি, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কেএম ওবায়দুর রহমান এরা অগ্রভাগে ছিলেন। আমাকে মূলত রাজনৈতিকভাবে যাতা দেয়ার জন্যই যখন ষড়যন্ত্র করা হলো তখন শেখ ফজলুল হক মণি প্রমুখেরা তাদের সঙ্গে হাত মেলালেন কেমন করে? আমি বিনম্রচিত্তে স্বীকার করবো সশস্ত্র যুব শক্তিকে সংগঠিত করার কাজে সরাসরিভাবে মোয়াজ্জেম ভাই, ওবায়েদ ভাই প্রমুখেরা নিয়োজিত না থাকলেও আমার প্রতি তাদের সক্রিয় সহমর্মিতা ছিল। ওপারের মুজিব বাহিনী গঠন প্রাক্কালে যারা এর নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণির অবস্থান ছিল তার অগ্রভাগে। তবুও তিনি সিরাজুল আলম খানের পাতা ফাঁদে পা দিলে আমাদের সঙ্গে সকল রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিন্ন করলেন। আমিও মনে মনে এই মানসিকতার প্রতিবাদে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম সুযোগ ও সুবিধা মতো প্রতিশোধ নেয়ার। অস্বীকার করবো না সিরাজুল আলম খান আমার এই সিদ্ধান্তটিকে উষ্কে দিয়েছিলেন। ৪ ঘণ্টার বৈঠকে আমি সিরাজ ভাইকে অনুনয় করেছিলাম বিষয়টি গোপন রাখতে এবং তার একান্ত ঘনিষ্ঠজনের কাছেও আমার মানসিকতাটা প্রকাশ না করতে। প্রাসঙ্গিকতার কারণে পুনর্ল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি সিএনসি স্পেশাল ও এফএফ-এ আমার শক্ত অবস্থানের কারণে যারা আমাকে মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল একই চিন্তায় বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও তাদের সমুচিত শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিশ্চয় প্রতিহিংসা পরায়ণতা নয় এমনকি মুজিব বাহিনীতে স্থান না পাওয়ার কারণেও নয়, আমার অবস্থানটি ছিল যেটা পরবর্তীকালে জাসদ ও গণবাহিনীতে রূপান্তরিত হয় তার বিপক্ষে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে সত্যটি আমি অনুধাবন করেছিলাম বা বিকল্প শক্তি প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমার যারা পৃষ্ঠপোষক বা অগ্রজ ছিলেন কোন যুক্তিতে তারা সেই বিশ্বাস থেকে দূরে সরে থাকবেন। আমাকে যেমন অসহায় ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে দূরে রাখার ফাঁদ পাতা হয়েছিল সেখানে কোন যুক্তিতে আমার অগ্রজরা প্রণোদনা দিয়েছিলেন। আজও আমি স্থিরপ্রত্যয়ে বিশ্বাস করি এটা শুধু প্রত্যয় ও প্রতীতির অভাব নয়, এটা একটি গভীর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততাও বটে। সততা নৈতিকতা আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার মানসিকতা এই সমস্ত প্রতিকূলতার মুখে আমাকে কেবল সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত করেনি বরং সকল অবস্থাতে প্রমাণ করেছে আমার সিদ্ধান্তটাই সঠিক ছিল। আমি আবারও বলি, যুবলীগ গঠিত হওয়ার পর মণি ভাই অকপটে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে স্বীকার করতেন তার ভুলটা কোথায় ছিল। জনান্তিকে জানিয়ে রাখা আমার নৈতিক দায়িত্ব ওই সময়কার ঘটনাপ্রবাহ আমার প্রাণের প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মি মুজিব ভাইয়ের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণসহ তুলে ধরতে পেরেছিলাম বলে তিনি ছাত্রলীগ বিভক্তির সময় আমাদেরই একক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের বর্জন করেছেন। স্বাধীনতা পূর্বকালে মুজিব ভাইয়ের চিত্তের দোদুল্যমানতা ছাত্রলীগের বিভক্তির সময় বিন্দুমাত্র কাজ করলে অনেক সংগঠন ও দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যেতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ই জানুয়ারি যখন বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন তখন প্লেন থেকে তাকে গ্রহণ করে ট্রাকে তার বাসভবনে সুযোগ ও সময় পেলে আমি একাগ্রচিত্তে যে কথাটি তাকে বলতে চেষ্টা করতাম যে, সিরাজুল আলম খান বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আঙ্গিকে রাজনৈতিক দল গঠন করবেন এবং বেসামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করে সশস্ত্র ক্যাডারসহ তিনি সমাজতান্ত্রিক আঙ্গিকে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলবেন। প্রথমদিকে মুজিব ভাই কথাটাই তেমন পাত্তা দেননি। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় হলো আমাদের এই কথাগুলো তিনি ফাঁস করে দেননি। যার ফলশ্রুতিতে সময় লাগলেও পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের বিভক্তি এবং তারও পরে সশস্ত্র ক্যাডার গণবাহিনীর সমন্বয়ে জাসদ গঠনের প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছ ধারণা তাকে দেয়া সম্ভব হয়েছিল। ফলে সিরাজ ভাইয়ের অনুসারীরা যখন পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সম্মেলন থেকে তার সরাসরি বিরোধিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন মুজিব ভাই বিস্ময়াভিভূতো হননি বরং নিঃসংশয়চিত্তে মুজিববাদীদের প্রত্যক্ষ সমর্থন দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর আগের একটি ঘটনা মুজিব ভাই যখন অস্ত্র জমা দেয়ার আহ্বান জানালেন তখন সিরাজুল আলম খান মুজিব ভাইকে ভুল বোঝাতে সক্ষম হন যে দেশের বিভিন্নস্থানে বিশেষ করে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির কাছে প্রচুর অস্ত্র রয়ে গেছে এই মুহূর্তে আমরা সকল অস্ত্র রাষ্ট্রের কাছে জমা দিয়ে দিলে ওরা আমাদেরকে নিঃশেষ করে ফেলবে। এই কথাটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ ছিল। মজার ব্যাপার হলো এই মুজিব ভাইয়ের অস্ত্র জমা দেয়ার উদাত্ত আহ্বানে বাংলার সকল অঞ্চল হতে প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দেয়ার উদ্দেশে সমগ্র অস্ত্র ঢাকায় নিয়ে আসেন। কিন্তু সিরাজ ভাইয়ের এই সুপরিকল্পিত নীলনকশায় বঙ্গবন্ধু কিছুটা বিভ্রান্ত হন এবং কিছু অস্ত্র সঙ্গোপনে রেখে দেয়ার জন্য সিরাজ ভাইকে অনুমতি প্রদান করেন। আমি তখন প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায় পিজি হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলাম। আমরা (চারজনই) আল্লাহর অশেষ রহমতে এই আংশিক অস্ত্র সমর্পণের অনুষ্ঠানে যোগদানে বিরত ছিলাম। বিষয়টিতে কেমন করে আমরা একমত হয়েছিলাম এটা আজও আমাকে বিস্মিত করে। যাই হোক পিজি হাসপাতালে রোগশয্যায় খবরটি যখন আমার কানে এলো তখন মৃত্যু ভয়কে তোয়াক্কা না করে আমি রাতের বেলায় চুপিসারে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আংশিক অস্ত্র রেখে দেয়ার সিদ্ধান্তটির বিরোধিতা করলাম। মুজিব ভাই তার স্বভাবসুলভ ঔদার্যে নিজে তো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেনই আমাকেও তিনি বোঝাতে চেষ্টা করলেন অস্ত্র যা জমা হওয়ার হয়ে যাক, আস্তে আস্তে সব অস্ত্রই আমি ছেঁকে তুলে নিবো। আমি কোনো অবস্থাতেই জাসদের সামরিক ক্যাডার গঠনের (গণবাহিনী) পরিকল্পনাটি তাকে বোঝাতে পারিনি। পরবর্তীতে সেটিই বঙ্গবন্ধুর জন্য কাল হলো। এই অস্ত্র দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশে গণবাহিনী গঠন করলেন সিরাজুল আলম খান। এই গণবাহিনী সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ তৈরি করে সমগ্র বাংলাদেশে বিভীষিকা ও নৈরাজ্যের পরিবেশ তৈরি করলো। ঈদের জামাতে সাংসদ হত্যা; বেবিচার; লুণ্ঠন; থানা লুট; খাদ্য গুদাম লুণ্ঠন; পাঠের গুদামে অগ্নিসংযোগ, নৈরাজ্য সৃষ্টি সকল পরিকল্পনা মহাউদ্যমে শুরু হলো যেটি প্রশাসনকে অনেকখানি দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পেরেছিল। মুজিব ভাইয়ের বাকশাল গঠনের মানসিকতার পেছনে এটাও অনেকটা প্রণোদনা জুগিয়েছিল। আমি সন্দিহান এই হত্যাযজ্ঞ লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগের খলনায়ক সিরাজুল আলম খানকে মুজিব ভাই পুরোপুরি শনাক্ত করতে পারেননি। কারণ, সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন এবং তার ফলশ্রুতিতে তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবস্থানও অটুট রাখতে পেরেছিলেন। জাসদের রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সরকারি বাসভবনটি দখল করে নেয়ার যে অপচেষ্টা হয়েছিল যা রুখতে গিয়ে অনেক জাসদ কর্মী হতাহত হয় এবং জাসদ পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে সশস্ত্র রাজনীতির প্রক্রিয়ায় চলে যায়- তারই একটি পরিকল্পনার অংশ ছিল এই গণবাহিনী। সন্দেহাতীতভাবে এটা বলা যায় তখন সিরাজুল আলম খান জাসদের প্রবাদ পুরুষ, অবিসংবাদিত নেতা এবং জাসদের সমগ্র সিদ্ধান্তের অপ্রতিরোধ্য প্রণেতা। তবে একটার পর একটা ভুল সিদ্ধান্তে তার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ হতে থাকে এবং ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে জাসদ ভেঙে যায়; বাসদ সৃষ্টি হয় এবং মূল জাসদের নেতৃত্বেও সিরাজুল আলম খানের প্রভাব ক্রমান্বয়ে বিলীন হতে থাকে। আজ সেটা প্রায় নিঃশেষিত। সিরাজুল আলম খান কিংবদন্তির মতো সংগঠক ছিলেন। সবকিছু ঘটিয়ে নিজকে আড়াল করে রাখার একটা অদ্ভুত কৌশলের মাধ্যমে নিজের একটি অভাবনীয় ভাবমূর্তি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। তার রাজনৈতিক সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তার একটিই কারণ সিরাজুল আলম খান অহধৎপযরংঃ নৈরাজ্যবাদী ছিলেন। তিনি কখনো জানতেন না আসলে তিনি কি চান। সমাজতন্ত্রের কথা বললেও তিনি কট্টর জাতীয়তাবাদী ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অদ্ভুত একটি স্বভাবের মানুষ। তিনি একসঙ্গে তিন চার দিন রাত্রি জেগে থাকতে পারতেন এবং কম্ভূকর্ণের মতো এক টানা সত্তর থেকে আশি ঘণ্টা ঘুমাতে পারতেন। এবং সে সময় তার টয়লেটতো প্রয়োজন হতোই না শুনেছি তিনি পেসাবও করতে উঠতেন না। এটা অমানবীয় না অতি দানবীয় এটা স্থির করা দুরূহ ব্যাপার।
যেদিন মিন্টুরোডে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাসায় সশস্ত্র আক্রমণের ঘটনাটি ঘটে আমি সেদিন রাতে বত্রিশ নম্বরে যাই। যখন আমি সিঁড়ি দিয়ে ওঠতে থাকি তখন মুজিব ভাইয়ের মেজো ছেলে শেখ জামাল আমাকে মুখে আঙুল দিয়ে নিশ্চুপ থাকতে বলেন। আমাকে নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে ওঠে আসার ইশারা করে শেখ জামাল ফিসফিস করে বলে আপনাকে আমি এমন একটা মজার নাটক দেখাবো যা আপনি এর আগে কখনও দেখেননি। আমি তার কথা মতো পা টিপে টিপে দোতলায় ওঠে শোবার ঘরের বারান্দা থেকে শেখ জামালের ইঙ্গিত মতো নাটকটি দেখে এতোটাই হতবাক হয়েছিলাম যে মূর্চ্ছা যাওয়া অসম্ভব কিছু ছিল না। দেখি সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর বুকে অদ্ভুত একটি কায়দায় তার দাড়ি ঘষছেন হয়তো কাঁদছেনও- অন্যদিকে মুজিব ভাই তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন আর কি যেন বলছেন। সিরাজ ভাইয়ের মুখটা সামনের দিকে ছিল বিধায় মৃদুস্বরের কথাটিও আমাদের কর্ণকুহরে পৌঁছালো। সিরাজুল আলম খান বলছিলেন, আপনি জাসদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিন। আমি রব-জলিলকে আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠিয়ে দেব। রাজপথে ওদের লম্পঝম্প চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ করে দেবো। সবকিছুর মধ্যেও এখনও আমার মনে হয় অনেক ষড়যন্ত্রের ঘটনার নায়ক সিরাজুল আলম খানের মুজিব ভাইয়ের প্রতি একটা দুর্বলতা ছিল। আমাদের চিন্তার সকলেই প্রায় এটাকে কৃত্রিম ও রাজনৈতিক কূটকৌশলের অংশ হিসেবে ভাবতেন। আমার ভাবনাটা অবশ্যই আলাদা ছিল। সেদিন যদি সিরাজ ভাইয়ের কুমন্ত্রণাই বিভ্রান্ত হয়ে মুজিব ভাই যদি কিছু অস্ত্র ফেরত দেয়ার ভুল সিদ্ধান্তটি না নিতেন তাহলে জাতি মহা সর্বনাশের হাত হতে রক্ষা পেতো। এতো প্রাণহানি হতো না; রক্ষীবাহিনী-গণবাহিনীর এতো খণ্ডযুদ্ধ হতো না; নৈরাজ্য ও গুপ্ত হত্যার কষাঘাতে জর্জরিত বঙ্গবন্ধুর মানসিকতা হয়তো বাকশাল গঠনে প্রণোদনা এতো প্রবলভাবে পেতো না। 
আমি অপকটে স্বীকার করি-বাকশাল গঠনের এটি একমাত্র উপাদান না হলেও অন্যতম প্রধান উপাদান। রক্ষীবাহিনী এমনকি সেনাবাহিনী নামিয়েও ওদেরকে নির্মূল করতে না পারলেও গণবাহিনীর অন্তর্দলীয় সংঘাত; নেতৃত্ব বিকাশের আত্মঘাতী প্রতিযোগিতা; একই দলের মধ্যে পরস্পরকে হত্যা করার হীনমন্যতা গণবাহিনীকে নিঃশেষিত করেছে। 
এই গণবাহিনীর অন্যতম নেতাও ছিলেন কর্নেল তাহের। তার প্রতি অনুগত নিয়মিত সেনাবাহিনীর কিছু সাফল্যের মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীকে রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে একটা প্রতিঘাতমূলক মানসিকতা গড়তে প্রচণ্ডভাবে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। ৭ই নভেম্বরে সিপাহী বিপ্লবের মূল নেতা ছিলেন জেনারেল জিয়া। কিন্তু সেনা ছাউনি হতে বেরিয়ে আসা বিদ্রোহী সৈন্যদের মধ্যে কর্নেল তাহেরের অনুগত কিছু সৈন্য সিপাহী বিপ্লবে প্রবল উৎসাহ প্রদান করে এবং সেনা ছাউনির অভ্যন্তরে নির্বিচারে অফিসার হত্যার মহোৎসবে মেতে ওঠে। ৩রা নভেম্বর হতে শুরু করে ৭ই নভেম্বরের এই অনাকাঙ্ক্ষিত সিপাহী বিপ্লবে অনেক সামরিক অফিসার প্রাণ হারান। জেনারেল জিয়াকেও কর্নেল তাহের জিয়ার নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে একটি গৃহে আটকে রাখে যেখানে কর্নেল তাহেরের প্রতি অনুগত সেনারা প্রহরায় থাকেন। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল বাংলাদেশ বেতার থেকে কর্নেল তাহেরের কণ্ঠ ভেসে এলে ওই সৈন্যরা জেনারেল জিয়াকে সাথে সাথে হত্যা করবে। খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা এই ঘটনাচক্রে প্রাণ হারিয়েছিলেন- তার বিশদ বর্ণনা এখানে আমি দেবো না। তবুও কর্নেল তাহেরের ষড়যন্ত্রের এই নেটওয়ার্ক থেকে জেনারেল জিয়া অলৌকিকভাবে ভাগ্যচক্রে রক্ষা পেয়ে যান। কারণ, কর্নেল তাহেরকে ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক তার ব্রিগেডের সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাংলাদেশ বেতার ভবন দখল করে ফেলেন, তাহেরের অনুগত সৈন্যদের নিরস্ত্র করেন এবং তৎক্ষণাৎ কর্নেল তাদেরকে গ্রেপ্তার করেন এবং কোনরকমের কালক্ষেপণ না করে জেনারেল জিয়াকে কর্নেল তাহেরের অবরুদ্ধ করার স্থান থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেন। এই ক্ষেত্রে ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক ও ঢাকায় অন্যান্য সেনাব্যক্তিত্বকে সঙ্গে নিয়ে জেনারেল জিয়া সিপাহী বিপ্লবের নামে বিদ্রোহী সেনাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রাণপণ প্রচেষ্টা শুরু করেন। অনেক ষড়যন্ত্রের অপবাদ তার নামের বিপরীতে থাকলেও সিপাহী বিপ্লবের নামে যে ভয়াবহ পরিকল্পনাটি সৃষ্টি হয়েছিল তাকে নিয়ন্ত্রণে এনে সামরিক বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্ব তাকে দিতেই হবে। 

সূত্রঃ মানবজমিন

Leave a Comment

এই বিভাগের আরও খবর

Copyright 2016 All rights reserved easynews24.com. Published by Azmari Huq on behalf of Unity Media House. Website Developed By Star Design BD