৩০১ মুক্তিযোদ্ধা ভুয়া প্রমাণিত
অনলাইন
তখন তারা ছিলেন শিশু। বেশির ভাগেরই বয়স ১ থেকে ৪ বছরের মধ্যে। সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির বয়সও সে সময় ছিল ১০ বছরের নিচে। আবার কারো কারো জন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধেরও বছর পাঁচেক পর। তাতে কি? এ বয়সকে বাধা মনে করেননি তারা। নিজেদেরকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেছেন। সেই দাবির স্বপক্ষে বলেছেন, ’৭১ সালে গঠিত অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন ক্যাম্পে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন তারা। দাবি প্রতিষ্ঠা করতে রীতিমতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাজির করেছেন। হাজির করেছেন, শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মনোনয়নপত্রসহ এ সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র। এ পর্যন্তই থেমে থাকেননি তারা, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেছেন সরকারি চাকরিও। এজন্য হেঁটেছেন আইনি পথে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে নিয়োগ দিতে তাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন আদালত। একজন, দু’জন বা তিনজন নয়। এ কৌশল নিয়েছিলেন তিন শতাধিক ব্যক্তি। তবে শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হয়েছে। গোমর ফাঁস হয়ে গেছে। ধরা পড়েছে প্রতারণার ভয়ঙ্কর কৌশল। জাল-জালিয়াতির অভিযোগে ফেঁসে গেছেন মামলায়। থানা পুলিশ ঘুরে মামলা গেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইতে। মামলা দায়েরের দীর্ঘ ১০ বছর পর ৯টি মামলার চার্জশিট হয়েছে। পিবিআইয়ের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সকল প্রক্রিয়া অত্যন্ত সুকৌশলে সম্পন্ন করেছেন এই ভূয়া মুক্তিযোদ্ধারা। নিখুঁত এ প্রতারণার কৌশল দেখে তারা নিজেরাও হতবাক হয়েছেন। তারা বলছেন, যেখানে যে কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে তার সবই হাজির করেছেন। তবে তদন্তে সবই ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। এ তদন্তের আলোকে তাদের ৩০১ আসামীর বিরুদ্ধে আদালতে চূড়ান্ত চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, তাদের এই জাল-জালিয়াতি প্রমাণ করা না গেলে সরকারি কোষাগার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যেত কথিত এই মুক্তিযোদ্ধাদের পকেটে। চাকরি না করলেও এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পরিশোধ করতে হতো এতোদিনের বেতন-বোনাস-অবসরকালীন ভাতা।
সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন এলাকার তিন শতাধিক ব্যক্তি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গঠিত অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী ছিলেন দাবি করে তারা। ১৯৮৫ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন বলেও দাবি করে। ওই মনোনয়নপত্র দেখিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন পদে নিয়োগদানের জন্য হাইকোর্টে রিট করেন। ৩১০ জন ব্যক্তি আদালতে ৯টি রিট করেন। রিট শুনানির পর হাইকোর্ট তাদেরকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন পদে আত্তীকরণের জন্য রায় দেন। এ রায় কার্যকর করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একটি ৩ সদস্য যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে। রিটকারীদের মুজিবনগর সরকারে কর্মচারী থাকা সংক্রান্ত সনদসহ শিক্ষাগত যোগ্যতার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই কমিটিতে দাখিল করতে বলা হয়। তাদের দাখিলকৃত কাগজপত্র দেখে সন্দেহ হয়। পরে তাদেরকে চাকরি দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয় রাজস্ব বোর্ড। একইসঙ্গে জাল কাগজপত্র দাখিল করায় প্রতারণার অভিযোগে ২০০৭ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তৎকালীন দ্বিতীয় সচিব গোলাম রহমান বাদী হয়ে ওই ৩১০ জনের বিরুদ্ধে রমনা থানায় পৃথক ৯টি মামলা করেন। দীর্ঘ তদন্তে রমনা থানার তদন্ত কর্মকর্তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই তদন্তে অভিযোগ সত্য বলা হলেও কোনো আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে ব্যর্থ হয় তারা। পরে অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত মামলাগুলো পিবিআই-এর দক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের প্রেক্ষিতে চারটি মামলার তদন্ত করেন পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক ও এসআইএন্ডও (অর্গানাইজড ক্রাইম) মো. নূরুন্নবী। অপর ৫টি মামলার তদন্ত করেন ঢাকা মহানগর পিবিআই পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ শামীম আহম্মেদ ও মো. সিরাজুল ইসলাম বাবুল। ইতিমধ্যে ৯ মামলারই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। প্রত্যেক আসামির ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন তারা।
সূত্র জানায়, ৯টি মামলাই করা হয়েছে ২০০৭ সালে। ওই বছরের ৮ই নভেম্বর দায়ের করা ২৪নং মামলার ৪৮ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। ২জন আসামির নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি। ১৪ই নভেম্বর দায়ের করা ৪৫নং মামলায় ৪৩ আসামির মধ্যে ৪০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়েছে। মামলার বাকি তিনজন মারা যাওয়ায় তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ২২শে নভেম্বর দায়ের করা ৮৬নং মামলার ২৩ আসামরি মধ্যে চার্জশিট দেয়া হয়েছে ১৯ জনের বিরুদ্ধে। বাকি ২ জন মারা গেছেন ও ২ জনের নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি। ৩রা ডিসেম্বর দায়ের করা ৬নং মামলার ৫৪ আসামির মধ্যে ৫২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। বাকি ২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা থাকলেও নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি। গত বছরের ১৮ই জুন এই চারটি মামলার চার্জশিট দিয়েছেন পুলিশ পরিদর্শক মো. নূরুন্নবী।
Leave a Comment