কুকুর লেলিয়ে মেধাবী ছাত্র হিমুকে হত্যার রায় ঘোষণা, ৫ জনের মৃত্যুদন্ড
অনলাইন
চট্টগ্রামে কুকুর লেলিয়ে মেধাবী ছাত্র হিমুকে হত্যার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রায়ে হিমুর পরিবার সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানিয়েছে। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ৫ আসামির মধ্যে বর্তমানে ৩ জন কারাগারে রয়েছেন। অন্যদিকে এক আসামি ঘটনার পরপরই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। আরেক আসামিও জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছে। গতকাল রোববার বিকাল ৪টায় চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. নুরুল ইসলাম এই রায় ঘোষণা করেন। আদালতে এর আগে নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
যে ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তারা হলো- শাহ সেলিম ওরফে টিপু, শাহাদাত হোসেন, মাহাবুব আলী, শাহ সেলিমের ছেলে জুনায়েদ রিয়াদ ও তার বন্ধু জাহিদুল ইসলাম। এদের মধ্যে কারাগারে আছে শাহ সেলিম, শাহাদাত ও মাহাবুব। পলাতক আছে জুনায়েদ ও জাহিদুল।
রায় ঘোষণার সময় হিমাদ্রী মজুমদার হিমুর মা ছাড়া পরিবারের সব সদস্য উপস্থিত ছিলেন। মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণায় হিমুর পিতা প্রবীর মজুমদার বলেন, রায়ে সন্তুষ্ট আমরা। যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের প্রত্যেকের ফাঁসি হয়েছে। ন্যায় বিচার পেয়েছি। আশা করছি, এই রায় দ্রুত কার্যকর করা হবে।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানিয়ে ৫ আসামির একজন শাহ সেলিম বলেন, আমি নির্দোষ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। তারপরও আমাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে অবশ্যই আপিল করবো।
গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টায় আদালত প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, রায়ের জন্য সেখানে হিমুর পরিবারের সঙ্গে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বাইরে অপেক্ষা করছেন। এ সময় ভেতরে রায় ঘোষণার পরপরই কান্নায় ভেঙে পড়েন হিমুর বাবা। তিনি বলেন, রায়ে খুনিদের ফাঁসি হয়েছে। এটুকু সান্ত্বনা। ছেলেকে তো আর পাবো না। বিকাল ৪টা বাজার কিছু সময় আগে আদালতে আসেন চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ নুরুল ইসলাম।
আদালতে বিচারক আসামিদের উপস্থিতিতে রায় পড়ে শোনান। রায় শুনে বিচলিত হয়ে পড়ে ৩ আসামি। পরে তারা কারাগারে যাওয়ার আগে ক্যামেরা দেখে মুখ ঢাকেন।
হিমুর পরিবারকে হুমকি
হিমাদ্রী মজুমদার হিমুকে পরিকল্পনা করে হত্যা করে আসামিরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে আসে কয়েকজন। এরপর শাহ সেলিমের ছেলে জুনায়েদ রিয়াদ তাদের পাঁচলাইশের একটি বাড়িতে নিয়ে যায় হিমুকে। সেখানে ছাদের উপর পুরনো ঘটনার জের ধরে জার্মান প্রজাতির হিংস্র কুকুরের খাঁচায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় তাকে। এরপর কুকুরের নৃশংস কামড়ে বাঁচতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে যায় সে। দিনটি ছিলো ২০১২ সালের ২৭শে এপ্রিল।
ঘটনাটি ঘটে নগরীর পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কের ‘ফরহাদ ম্যানশন’ নামে একটি চার তলা ভবনের ছাদে। সেখানেই হিমুকে হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দিয়ে নির্মম নির্যাতন ও পরে নিচে ফেলে দেয়া হয়।
২৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ার পর রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান সামার ফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওই ছাত্র। মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করায় এলাকার কয়েক জন বখাটে যুবক এ কাজ করে। এ ঘটনায় নিহতের মামা অসীত কুমার দে বাদী হয়ে পাঁচ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
চাঞ্চল্যকর কুকুর লেলিয়ে এই হত্যার ঘটনায় হিমুর পিতা বিচার পেতে আদালতে ফরিয়াদ জানান। আকুল আবেদন করে বলেছিলেন, ছেলেকে হারিয়ে বড় নিঃস্ব সময় কাটছে সন্তানহারা এই পিতার। নির্বাক হয়ে আছে তার মা। এমন নৃশংস ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চান তিনি। শাস্তি চান এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের।
ঘটনার পর থেকে ছেলের শোকে হিমুর মা পাথর হয়ে গেছেন। এই অবস্থায় অজ্ঞাত স্থান থেকে মামলা তুলে নিতে বহুবার তাদের ওপর হুমকি ধামকি দেয়া হয়েছে। মামলাকে ভিন্নভাবে প্রবাহিত করার জন্য প্রভাবশালী একটি মহল বহুভাবে চেষ্টা করেছে। দীর্ঘ দুই বছর পর বিচার শুরু হয় এই মামলার। ২০১৪ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি আদালত পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। তবে চলতি বছরের গত ২৮শে জুলাই ও ১১ই আগস্ট দুইবার এই মামলার রায় ঘোষণার তারিখ পেছানো হয়।
সন্তানের আত্মা শান্তি পাবে
হিমাদ্রী মজুমদার হিমুর বাবা প্রবীর মজুমদার রায় ঘোষণার পর গতকাল রোববার বিকালে আদালতে সাংবাদিকদের বলেন, অনেক কষ্ট সহ্য করেছি আমরা। ছেলেকে হারিয়ে পিতা হয়ে বুকে পাথর বেঁধেছিলাম। কুকুর লেলিয়ে হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো হয়নি। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যারা আমার ছেলেকে খুন করেছে তাদের যেনো কঠিন সাজা হোক।
তিনি আরো বলেন, আমি চাই খুব দ্রুত এই ঘটনার রায় কার্যকর করা হোক। যারা পালিয়ে রয়েছে তাদেরকে শিগগিরই আসামির কাঠগড়ায় নিয়ে আসার দায়িত্ব পুলিশ বিভাগের। এই সমাজের আর কোনো বাবা-মায়ের যাতে সন্তান অকালে চলে না যায়। সন্তান হারানোর জ্বালা কেবল পিতাই বোঝে।
তিনি বলেন, সবাই এই ঘটনার শাস্তি চেয়েছে। মামলার কার্যক্রম নিয়ে শংকায় ছিলাম। ২১ জন সাক্ষীর মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের ২১শে জুলাই এক আসামির করা আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলায় ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্টের বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও জাফর আহমদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। পরে সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় মামলার কার্যক্রম আবার শুরু হয়।
হিমুর মামা অসীত বলেন, হিমু মাদকবিরোধী সংগঠন শিকড়ের সদস্য। কিন্তু যারা তাকে হত্যা করেছে তারা ইয়াবা নয়তো গাঁজায় আসক্ত। ২০১১ সালের ২৬শে অক্টোবর শিকড়ের পক্ষ থেকে এম ইসমাইল নামের একজন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এ নিয়ে ওই সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে আসামিদের বিরোধের সূত্রপাত হয়। পরে তারা প্ল্যান করে হিমুকে হত্যা করে।
হিমুর বাসায় মায়ের জল
গতকাল রোববার বিকালে আদালতে রায় ঘোষণার পরপরই যাওয়া হয় হিমুর বাসায়। সেখানে দেখা যায় পুরো পরিবারের সবাই সৃষ্টিকর্তার কাছে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে প্রার্থনা করছেন। এই সময় হিমুর মা গোপা মজুমদার বলেন, সকাল থেকে ঠাকুরের আসনে বসে ছিলেন তিনি। বলেন, এর আগে দুইবার রায় পেছানো হয়েছে তাই এবার শংকিত ছিলাম। তবে কি খুনিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। বিকালে ফোনে যখন জানতে পারলাম? তখন ছেলের ছবি বুকে নিয়ে অঝোরে কেঁদেছি।
তিনি বলেন, গত কয়েকটা বছর আমাদের বাসায় হাসি কি তা জানা ছিলো না। হয়তো ভবিষ্যৎতেও আর কখনো সবাই মিলে আনন্দ করা হবে না। কারণ ছেলে হারানোর শোক সারাজীবন বইতে হবে।
নগরীর হেম সেন লেইনের বাড়িতে বাবা- মায়ের সঙ্গে বসবাস করতেন হিমু। তার মৃত্যুর পর সেই বাসায় এখন কেবলই শূন্যতা। মৃত্যুর আগে ঘরের ভেতর দেয়াল জুড়ে ছিল তার বিভিন্ন ছবি, চিত্রকর্ম। কিন্তু সেই বাসায় এখন দেয়ালে তেমন কোনো পেইন্টিংস নেই।
পুরো বাসায় শুধুমাত্র বসার কক্ষে খানিক অন্ধকারের মধ্যে ঝুলছে হিমুর একটি ছবি। হিমুর স্মৃতি মুছে ফেলতে তার মৃত্যুর পর পড়ার টেবিলটি বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। গিটারটি মুছে রাখা হয়েছে আলমারিতে। সব কাপড়চোপড় দান করা হয়েছে গরিব লোকজনকে।
মা গোপা মজুমদার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলে হত্যার বিচার দেখে মরতে চাই। আমার বুক যারা খালি করেছে সৃষ্টিকর্তা যেনো তাদের খুব কঠিন শাস্তি দেয়। যাতে ওরা বুঝতে পারে সন্তান হারানোর বেদনা সহ্য করা একজন বাবার জন্য কতটা কঠিন।
তিনি আরো বলেন, আজও প্রতিরাতে ঘুমের ঘোরে হিমুর ডাক শুনতে পাই। দৌড়ে যাই। একা একা ঘরে টাঙানো ছবিটার দিকে চেয়ে থাকি। এই বুঝি ছেলেটা এসেছে। কিন্তু সবই ভুল হয়ে যায়। ছেলের শোক আর সইতে পারছি না।
Leave a Comment